লোডশেডিং :ডিজেলের খরচ বাঁচানো :এসবের অর্থ কী
লেখক: ড. আর এম দেবনাথ | মঙ্গলবার, ৩ এপ্রিল ২০১২, ২০ চৈত্র ১৪১৮, দৈনিক ইত্তেফাক
আমার এক পরিচিত লোক অবসর নিয়েছেন বেশ অনেকদিন। সারাজীবন যা করেননি তা অবসরের পর করা শুরু করেছেন। হিসাব রাখা, খরচের হিসাব রাখা। কয়েকদিন আগে তার সাথে বাজারে দেখা। প্রথমেই বললেন, হিসাব রাখতে গিয়ে তার বিপদ হচ্ছে। কারণ সব মাসেই একটা না একটা খরচ থাকে যার অগ্রিম চিন্তা তার থাকে না। যেমন মার্চ মাসের হিসাবে ঢুকেছে বিদ্যুতের বিকল্প খরচের খতিয়ান। প্রচণ্ড লোডশেডিং-এর কবলে পড়ে গেলো বছর তাকে হ্যারিকেন কিনতে হয়েছিল। সেটি নষ্ট হয়ে যায়। ঝালাই করতে লাগে এখন ৪০ টাকা। বলেন কী, ৪০ টাকা! উনি বললেন— আপনি কোথায় আছেন? পুরনো পাঞ্জাবিতে একটা বুক পকেট সেলাই করতে লাগে ৫০ টাকা। কাপড় নয়, শুধু সেলাই চার্জ। বললেন, হ্যারিকেনের দাম ১৫০ টাকা, মেরামতি খরচ ৪০ টাকা। বাসায় হায়ার সেকেন্ডারির ছাত্রী আছে। বিদ্যুত্ না থাকলেও পড়ে মোমবাতির আলোতে। কেরোসিনের গন্ধ সে সইতে পারে না। ছয়টা ছোট মোমবাতির দাম ৩৫ টাকা। দুই-তিনদিনও এতে যায় না। এক হ্যারিকেন সাদা কেরোসিনের খরচ ২০ টাকা, ৬৫ টাকা লিটার। ভদ্রলোককে মশারি কিনতে হয় দুটো। একেকটার দাম ৬০০ টাকা করে। আগের মশারির মধ্যে একটা নষ্ট হয়ে গেছে। বিদ্যুতের অভাবে মশার কামড় খেতে হয়। ঘনঘন বিদ্যুত্ যায়। ঘন্টায় ঘন্টায় বিদ্যুত্ যায়। এতে পানীয়জলেরও কষ্ট। পানীয়জল মাঝে-মধ্যেই বুয়াকে দিয়ে তুলতে হয় তিনতলায়। পরিচিত বন্ু্লটির এসব হিসাব শুনে আমি অনেকটা অপ্রস্তুত। অপ্রস্তুত এ কারণে, দেখলাম অবসরপ্রাপ্ত হলে কী হবে! তিনি পাই পাই করে হিসাব রাখেন। বললেন— রোজগার তো আবার কমে গেল। মেয়াদি আমানতে কিছুদিন পেয়েছি ১৪ শতাংশ সুদ। এখন সাড়ে বারো শতাংশ। এসব হিসাব দিতে দিতেই তিনি দুঃখ করে বলেন— এত আশা নিয়ে মহাজোটকে ভোট দিলাম, তার পরিণতি এই! ভদ্রলোক ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক, সক্রিয় কর্মী নন। তিনি হতাশ। তার প্রশ্ন: এত বিদ্যুত্ যায় কোথায়? সরকার বলছে— গত তিন বছরে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ নতুনভাবে উত্পাদনে গেছে। যদি তাই হয় তাহলে এই বিদ্যুত্ কোথায়? তার অভিযোগ, এই হিসাবে কোন গণ্ডগোল আছে। নতুবা গণ্ডগোল আছে চাহিদার হিসাবে। নতুবা গণ্ডগোল আছে কেনা-বেচায়। তিনি এর ব্যাখ্যা জানতে চান। তার খরচ বেড়েছে, লোডশেডিং-এ তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের মত ভুগছেন তাতে তার আফসোস নেই। তিনি প্রকৃত অবস্থা জানতে চান। তার বিশ্বাস, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসব বিস্তারিত জানেন না।
প্রকৃত অবস্থার নানা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যেদিন এই কলাম লিখছি সেদিন একটি দৈনিকে বিদ্যুতের ওপর একটা স্টোরি ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড’ জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুত্ কেন্দ্রের মধ্যে অনেকগুলো বন্ধ রেখেছে। কারণ? কারণ তাদের টাকা নেই জ্বালানি আমদানির জন্য। ‘পিডিবি’র নাকি চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুত্ উত্পাদনের ক্ষমতা আছে। কিন্তু বিদ্যুত্ কেন্দ্র বন্ধ রাখতে বাধ্য হওয়ায় তারা তা পারছে না। বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা ৬৭০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে কৃষির দরকার ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্। পিডিবি এখন উত্পাদন করছে ৫২০০ মেগাওয়াট। বেশি বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে মাসে পিডিবির লাগবে ১০০০ কোটি টাকার ভর্তুকি। পিডিবিকে দেয়া হয়েছিল ৫২০০ কোটি টাকা। ইতিমধ্যেই ৫০০০ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। অতএব, বিকল্পহীন তারা। আরেকটি কাগজে দেখলাম সার কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, কিন্তু তা সময়মত বন্ধ না করায় বিদ্যুত্ ঘাটতি বেড়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে ডিজেল আমদানি দুই-তৃতীয়াংশ কমাতে হবে। অতএব, উত্পাদন হ্রাস। অতএব, লোডশেডিং। কী কারণে ডিজেল আমদানি হ্রাসের সিদ্ধান্ত? সরকারের হাতে ডলার নেই। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে যা দিয়ে তিন মাসের আমদানির ব্যয় মেটানো যায় না। ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্টের’ অবস্থা সঙ্গীন। সরকারি ব্যাংক ঋণপত্র খুলতে চায় না। পেট্রোবাংলার কাছে তাদের পাওনা মাত্রাতিরিক্ত। আমদানি করে ডলারের অভাবে ঋণপত্রের চাহিদা মেটানো না গেলে ব্যাংকগুলো পড়বে মহাবিপদে। ভবিষ্যতে রপ্তানিকারকের ব্যাংক বিদেশি ব্যাংকের ‘এ্যাড কনফার্মেশন’ চাইতে পারে, পেমেন্ট নিশ্চিত করার জন্য। এতে সরকারি ব্যাংকের খরচ বাড়বে, সুনাম ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। বিদেশি ক্রেডিট লাইনও বড় বেশি শক্ত নয়। অতএব, বিকল্প কী? বিকল্পহীন সরকার মাথা কেটে ফেলল। কৃষিতে বিদ্যুত্ দেয়ার কথা বলে বিদ্যুত্ উত্পাদনই হ্রাস করে দিল। অথচ এই তথ্যটি মানুষকে জানানো হচ্ছে না।
মানুষকে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বলা হচ্ছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় বিদ্যুত্ উত্পাদনের স্তর ছিল ৩২৬৭ মেগাওয়াট। সরকার যেহেতু অতীত সরকারের ব্যর্থতার কথা প্রচার করে, তাই স্বভাবতই প্রত্যাশা সরকার ৩,২৬৭ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন অব্যাহত রাখবে। দ্বিতীয় সরকার বলছে গত তিন বছরে সরকারি ও বেসরকারি খাতে নতুন বিদ্যুত্ উত্পাদিত হয়েছে ২,৯৪৪ মেগাওয়াট এবং মার্চ মাসে নতুন যোগ হয়েছে আরো ১৫২ মেগাওয়াট। তাহলে বিদ্যুতের প্রাপ্যতা হয় ৩,২৬৭ যোগ ২৯৪৪ যোগ ১৫২ মেগাওয়াট অর্থাত্ ৬,৩৬৩ মেগাওয়াট। অথচ চাহিদার কথা বলা হচ্ছে ৬৭০০ মেগাওয়াট। এই চাহিদার হিসাব কতটুকু সঠিক? বাজারে শোনা যায়, বিদ্যুত্ বিভাগের কর্মকর্তাদের একাংশ অবৈধভাবে প্রচুর নতুন ‘কানেকশন’ দিয়ে চাহিদা বাড়িয়েছে। এটা সত্য হলে এই বিদ্যুেক বলা যায় ‘সিসটেম লস’। বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ানো হল, বিদ্যুত্ ভোগ হল অথচ বিদ্যুতের বিল হল না, টাকা আসল না। কী মারাত্মক কথা, যখন একটা টাকাও সরকারের জন্য মূল্যবান তখন নতুন সংযোগের নামে এই সিসটেম লসের কারণ কী? এর দ্বারা যারা প্রকৃত গ্রাহক তাদেরকে ভোগানো কেন? এর জন্য কার শাস্তি পাওয়ার কথা? তিনি বা তারা পাবেন কী?
আরেক কথা। বেসরকারি খাতের বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলো যে বিদ্যুত্ সরকারের কাছে বিক্রি করে তার হিসাব ঠিক আছে তো? এটা আবার মাটি কাটার হিসাবের মত নয়তো? যদি তা হয় তাহলে খাতাপত্রে দেখা যাবে বিদ্যুতের সরবরাহ বেশি যা প্রকৃত অবস্থা নয়। আমার কিন্তু এসব ব্যাপারে সন্দেহ আছে। আমাদের বেসরকারি খাতের অধিকাংশের যে রেকর্ড এবং পিডিবির কর্মকর্তাদের যে রেকর্ড তাতে বিদ্যুতের প্রাপ্যতার হিসাব নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। দেখা যাবে তারা টাকা নিচ্ছে ১০০ ইউনিটের, অথচ দিচ্ছে ৮০ ইউনিট। বলা হবে ‘মেকানাইজড সিসটেমে’ এটা সম্ভব নয়। এটা বিশ্বাস করতাম যদিবা টেলিফোনের অভিজ্ঞতা থাকত। ‘কমপিউটারাইজড সিসটেমে’ বিল হয়, কিন্তু কল না করলেও সেই কলের টাকা যোগ হয় কী করে? কমপিউটার শত হোক তা মানুষ চালায়। পরিণামে ভুগছি আমরা সাধারণ বিদ্যুত্ ব্যবহারকারীরা।
এই মুহূর্তে দেশে দুইটি বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে এবং সরকারের পারফরমেন্স প্রশ্নবিদ্ধ। প্রথমটা হচ্ছে বিদ্যুত্হীনতা। সাথেই প্রশ্ন বিদ্যুত্ যাচ্ছে কোথায়? দ্বিতীয়ত প্রশ্ন হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। এটা মজার দেশ! সরকার বিদ্যুত্ দিতে পারছে না। কিন্তু অবলীলাক্রমে তার দাম বাড়াচ্ছে। বিদ্যুত্ দিয়ে যদি বলা হত দাম বাড়ালাম এইটুকু দেশবাসীকে সহ্য করতে হবে। না, এটা নয়। বিদ্যুত্ নেই। অথচ দাম বাড়ানো হচ্ছে। আমি দাম বাড়ানোতে হৈচৈ করব না। সব জিনিসের দাম বাড়ে। এখানেও বাড়তে পারে, তবে তা সহ্যাতীত যাতে না হয়। নিবন্ধের শুরুতে যে বন্ধুর কথা উল্লেখ করলাম তাতে দেখা যায়, বিদ্যুত্ না থাকলে মানুষের বিদ্যুতের বিকল্প খরচ অনেক বাড়ে। সেই অনুপাতে বিদ্যুতের দাম বাড়লে আপত্তির কিছু দেখি না। দেখি না কারণ এতে অন্তত বাড়িতে বসে কষ্ট করতে হয় না। এসএসসি ও এইচএসসির ছাত্র-ছাত্রীরাসহ অন্যান্য কেউ বিদ্যুতের অভাবে ভুগে না। জীবন থাকে নির্বিঘ্ন। বিদ্যুত্হীনতা জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দেয়। অতএব, বিদ্যুতের দাম সহনশীলভাবে বাড়লে তাতে আমি আপত্তি করব না। তবে আমাকে অবশ্যই নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুত্ দিতে হবে যাতে ‘আইপিএসের’ টাকা বহন না করতে হয়। যাতে ডিজেলের খরচ আমাকে না বহন করতে হয়।
একটা প্রশ্ন আমার মনে। দেখা যাচ্ছে জ্বালানি তেলের খরচও তত্সম্পর্কিত ভর্তুকিই এই মুহূর্তের বড় সমস্যা। সরকার জ্বালানির টাকা সাশ্রয় করতে চায়, ভর্তুকির টাকা বাজেটের মধ্যে রাখতে চায়। সামনে বাজেট আসছে। অর্থমন্ত্রীকে তার বাজেট দিতে হবে। একটা স্বচ্ছ বাজেট দরকার। বিদেশিরা যাতে খুশি না হোক, অন্তত অখুশি না হয়! এজন্যই ডিজেল আমদানি হ্রাস করে বিদ্যুত্ উত্পাদন হ্রাস করা হয়েছে এবং করা হচ্ছে লোডশেডিং। এখানেই আমার প্রশ্ন: এটা মার্চ মাসে কেন? মার্চ, এপ্রিল, মে গরমের মাস। এই সময় বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। গৃহস্থালি ব্যবহারের জন্য বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ে, কৃষিতেও চাহিদা বাড়ে। এই সময় ফসলের মাঠে জলের দরকার। বৃষ্টি না হলে আরো বেশি জলের দরকার। এটা আসবে সেচ থেকে। সেচ চলবে বিদ্যুত্ হলে। এসব ঝামেলা অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বরের দিকে থাকে না। তখন শীতকাল। শীতকালে বিদ্যুত্ ছাড়াও একজন চলতে পারে। কষ্ট হলেও তা সহ্যের মধ্যে থাকে। যদি জ্বালানি খরচ কমানোই কাম্য হয় তাহলে তখন লোডশেডিং করা হল না কেন? তখন টাকা সাশ্রয় করে এখন তা খরচ করা যেত। মানুষ কম কষ্ট পেত। হৈচৈ কম হত। সরকারকে গালমন্দ করত কম। কারণ তখন কোন পরীক্ষা ছিল না। তখন কৃষির জন্য বিদ্যুতের দরকার ছিল না। তখন ঠাণ্ডা ছিল, গরম ছিল না। এমন একটা সময়ে দেখলাম আমরা আরামে আছি। কোন লোডশেডিং নেই। কারো মুখে কোন অভিযোগ নেই। আমি তো সরকারের প্রচারিত তথ্য দেখে মনেই করেছিলাম যাক একটা আপদ থেকে বাংলার মানুষ মুক্তি পেল। মনে মনে সরকারের প্রশংসাও করেছি। হা হতোস্মি! এমন যে ঘটবে তা কী জানতাম! এখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং। এই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত না নেয়ার জন্য কে দায়ী হবেন? যাকে বা যাদেরকে দায়ী করতে চাই, বাজারে শুনি তারা না কি খুবই ক্ষমতাধর। তারা কাউকে ‘কেয়ার’ করেন না। তাদের জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা নেই। বিরোধীদের তারা না কি ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দিতে পারে। এই ভয়েই কিছু কিশোরগঞ্জের ভাষা আছে সমালোচনায় তা করলাম না। কিন্তু গায়ের জ্বালা তো মিটে না। সরকারের ভেতরের সরকার কী সব খাবলা খাবলা করে খাবে? সময়মত সারকারখানা বন্ধ হয় না, সময়মত গ্যাস থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার হচ্ছে না, ডিসেম্বরে লোডশেডিং করে জ্বালানি সাশ্রয় না করে মার্চ মাসে/এপ্রিল মাসে লোডশেডিং করা ইত্যাদি ঘটনা থেকে মনে হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে সবকিছু জানানো হচ্ছে না। আপনি নিজ উদ্যোগে জানবেন এবং মানুষের কষ্ট লাঘব করবেন এটাই সকলের প্রত্যাশা। কারণ অনির্বাচিতরা নন আপনাকেই মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
E-mail: rmdebnath@yahoo.com

হোম সম্পাদকীয় লোডশেডিং :ডিজেলের খরচ বাঁচানো :এসবের অর্থ কী

http://new.ittefaq.com.bd/news/view/87308/2012-04-03/3

Reply · Report Post